☰ |
|
কলাম |
মুহাম্মদ মহিউদ্দিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এমন পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছিল, যেকোনও সময় প্রতিহিংসামূলক প্রতিপক্ষকে এই আইনের আওতায় ফেলে দেওয়া যায়। ভয় দেখানো যায়। অথবা ভয়ে রাখা যায়। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। দুটি আইনের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকমের। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের যেসব আপত্তি-উদ্বেগ ছিল, প্রস্তাবিত নতুন আইনেও সেসব দূর করা হয়নি। শুধু কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হয়েছে এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। এবং মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের (প্রমাণিত হলে) ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের পরিবর্তে শুধু জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের কথা বলেছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংগঠন। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে আগের মতোই বিষয়বস্তু হুবহু বহাল রাখা হয়েছে। ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনও প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার জন্য দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। প্রস্তাবিত আইনে শুধু সাজা কমিয়ে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অর্থদণ্ড আগের মতোই ১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন বা ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। প্রস্তাবিত আইনে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত বিষয় নতুন আইনে একই রয়েছে, বিষয়বস্তুর অস্পষ্টতা দূর করা হয়নি। এই ধারায় অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড কমিয়ে ২ বছর বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কমিয়ে ৫ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ড হবে, এমন প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি অপরাধের বিষয়ে বলা আছে, কোনও ব্যক্তি এই অপরাধ করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিষয়বস্তু একই রেখে সাজা কমিয়ে ২ বছর করা হয়েছে। তবে জরিমানার পরিমাণ পরিবর্তন করা হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই অপরাধের জন্য কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে শুধু জরিমানার শাস্তি রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল ৫ লাখ টাকা। কারাদণ্ডের বিধান মওকুফ করে বিশাল অঙ্কের টাকা জরিমানা রাখার কারণ জনগণকে ভয় দেখানো। কারাদণ্ড মওকুফের সংশোধনীকে স্বাগত জানাই, কিন্তু জরিমানা কমানো উচিত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো বা ঘটার উপক্রম-সংক্রান্ত অপরাধের কথা রয়েছে। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড রয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই সাজা কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। আর অর্থদণ্ড বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে কারাদণ্ড সর্বোচ্চ সাত বছর বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের এই সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের আইন বর্তমানে কতটা সময়োপযোগী তা ভেবে দেখার বিষয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ৮-এর বিষয়বস্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও হুবহু রাখা হয়েছে। এই আইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করবে। বিরোধী মত ও ভিন্নমত দমনে সরকারি সেন্সরবোর্ড হিসেবে কাজ করবে নিবর্তনমূলক এই আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে (খসড়ায় ৪২ ধারা) বিষয়বস্তু ও সাজার বিষয়টি হুবহু এক রাখা হয়েছে। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার সংক্রান্ত এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, কোনও স্থানে এই আইনের অধীন কোনও অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনও উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে ওই কর্মকর্তা বিশ্বাসের কারণ লিখে ওই স্থানে প্রবেশ করে তল্লাশি এবং প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। এছাড়া ওই স্থানে তল্লাশিকালে পাওয়া অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনও দলিল জব্দ করতে পারবেন। এমনকি ওই স্থানে উপস্থিত যেকোনও ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, সন্দেহ হলে গ্রেফতার করতে পারবেন। এই আইনের মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত এক ধরনের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে, ফলে ভিন্নমত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশ ধরাকে সরা জ্ঞান করবে, এটাই ধরে নেওয়া যায়। যথেষ্ট প্রমাণ এবং পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেফতার করা যাবে না এই মর্মে প্রস্তাবিত আইনে সংশোধনী আনা প্রয়োজন। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। ব্যক্তিগত দর্শন থেকে যে কেউ তার মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার রাখে। এখন কোনও ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যদি তার মত প্রকাশ করে তা সমাজের প্রতিটি মানুষের মতাদর্শের সঙ্গে মিল না হওয়াটাই স্বাভাবিক। চুরি এবং দুর্নীতির বিপক্ষে কথা বললে যারা চোর অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের অপমানবোধ হতেই পারে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি সমাজের চোখে হেয় হতে পারেন। তাই বলে কি তিনি সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশ করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করবেন? তাকে জেলের ঘানি টানাবেন? সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগে ঠিক এমনটিই হবে। জুলাই ২০২১ ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে বরাদ্দের বিপরীতে রোগীর খাবার পরিবেশনে অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, জনরোষ সৃষ্টিকারী মানহানিকর’ উল্লেখ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে। পরে এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সরকারের সাইবার আইনের প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানিয়ে বলতে চাই, এই আইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সংশোধন করে প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। তবে আইন ও নীতিমালার খসড়া তৈরিতে মানবাধিকারকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী এবং সাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তা দিয়েছে আমাদের সংবিধান। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তিও বটে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধের সংজ্ঞায় পরিবর্তন না করায় এর যথেষ্ট অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে কঠোর অস্বচ্ছ ও নিবর্তনমূলক ধারাগুলোর সংশোধন না হলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত থাকবে। এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করবে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেক মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দমনে মামলার বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে থাকা উচিত। লেখক: সেক্রেটারি জেনারেল, পেন বাংলাদেশ |
কলাম |
সর্বশেষ |
xxxxxxxxxxxxxxxxx |