মুশফিকুর রহমান মার্কিন সংবাদপত্র দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আফ্রিকায় চীনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিরোধীতা করে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনটিতে আফ্রিকায় চীনা উপস্থিতির সমালোচনা করে লিখছে, বেজিংয়ের ঋণের ফাঁদ আফ্রিকায় আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসবে। আফ্রিকা হলো আমেরিকার ব্যাক ইয়ার্ড, সেখানে চীনের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একেবারেই অস্বস্থিকর। এখন প্রশ্ন হলোÑ‘আফ্রিকা আমেরিকার ব্যাক ইয়ার্ড হলে ইউক্রেন রাশিয়ার কোন ইয়ার্ড?’ ওয়ারশ জোট ভেঙ্গে যাবার পর ন্যাটো জোটের আদৌ কি প্রয়োজন ছিল? কিন্তু আমেরিকা তাঁর ভূরাজনীতির স্বার্থে সামরিক জোট ন্যাটোকে টিকিয়ে রাখে। উত্তর আটলান্টিক এই জোটকে শুধু টিকিয়েই রাখেনি ; এই জোটকে আরো আগ্রাসী শক্তি হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। মূলত রাশিয়াকে চাপে রাখতে পূর্ব ইউরোপের সাবেক সোভিয়েত বøকের সবকটি রাষ্ট্রকে ন্যাটোর সদস্য করে নেয়। পরবর্তিতে আমেরিকা এসব দেশে সেনা ও অস্ত্রসস্ত্র মোতায়েত করে। মলদাভিয়া, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটো জোটের সদস্য করতে আমেরিকা এগিয়ে আসে। ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণের মূল লক্ষ হলো ভবিষ্যতে রাশিয়াকে আরেকটি যুগোশ্লাভিয়ায় পরিণত করা। ১৯৯০ সালেও ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। আর সেই ইউক্রেনে ন্যাটোর ঘাঁটি স্থাপন বা ইউক্রেন ন্যাটো বলয়ে যোগদান রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের মূল কারণ হচ্ছে ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রতিহত করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং আরও ৮টি ইউরোপীয় দেশসহ ১২ সদস্য একে অপরকে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগীতার অঙ্গীকার নিয়ে উত্তর আটলান্টিক জোট ন্যাটো গঠিত হয়। কয়েক দশক ধরে ন্যাটো জোট বড় হতে থাকে। বর্তমানে ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ৩০। ২০০৯ সালে আলবেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যোগ দেয়। ন্যাটো হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক সংগঠন। ন্যাটোর সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর খরচ পৃথিবীর সব দেশের সামরিক খরচের প্রায় ৭৫ ভাগ। ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে রুশ। জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ রুশ ভাষায় কথা বলে। তাদের সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে। রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইউক্রেনকে তার বাড়ির পেছনের আঙ্গিনা বলে বিবেচনা করে। প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, পশ্চিমা শক্তি আসলে ন্যাটো জোটকে ব্যবহার করে চারিদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলছে। তিনি চান ন্যাটো যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের সামরিক তৎপরতা কমিয়ে আনে। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটকে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, সে প্রতিশ্রæতি তারা রাখেনি। ইউক্রেন ন্যাটো জোটের সদস্য হলে শুধু যে রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে তাই নয় ; রাশিয়াকে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার পরিণতি বরণ করতে হবে। রাাশিয়া ও চীনকে চাপে রাখতে ন্যাটোকে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর একক পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকা (১৯৮৮-২০১৪) আচরণ কারোরই অজানা নয়। সিনিয়র বুশ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা’র শ্লোগান তুলে বিশ্বে পশ্চিমা নীতি চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ইরাকের কুয়েত দখলের অজুহাত দেখিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক লক্ষ মার্কিন ও ন্যাটো সেনা মোতায়েত করে। মার্কিন ষড়যন্ত্র আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, হাইতি, নিকারাগুয়া ও সোমালিয়ায় ‘রেজিম’ পরিবর্তনের নামে দেশগুলোকে ধ্বংসস্ত’পে পরিণত করে। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের বিমান হামলায় প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বাস্তÍচ্যুত হয়। যে সব দেশে সামরিক আগ্রাসনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি সেখানে একের পর এক অবরোধ দিয়ে দেশগুলোর জনগণের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্থ করে তোলে। ন্যাটোর অব্যাহত সম্প্রসারণে পরবর্তি টার্গেট হবে গণচীন। আমেরিকার এই নোংরা খেলা খুবেই পুরনো। পুতিন ভালো করেই জানে, ন্যাটোর সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকলে শুধু যে রাশিয়া ও চীন ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয় ; বিশ্বের বাকি সব সভ্যতার অপমৃত্যু হবে। ২০১৪ সালে কিয়েবে রুশপন্থ্রী সরকারের পতন হলে রাশিয়া ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়। এদিকে ন্যাটো জোটের অস্ত্রে বলিয়ান হয়ে উঠে কিয়েব। ইউক্রেনের ইহুদি প্রেসিডেন্ট জেলোনস্কি ইসরাইল, আমেরিকা ও ন্যাটোর সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তুলে। ন্যাটো টিকে থাকলে বিশ্বে আমেরিকার আগ্রাসন বন্ধ হবে না। আমেরিকার এই নোংরা খেলা বন্ধ করতে না পারলে রাশিয়া ও চীন মারাতœক হুমকির মধ্যে পড়বে। সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৯৬২ সালে কিউবাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল ঘাটি স্থাপন যেমন আমেরিকার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি তেমনি বর্তমানে ইউক্রেন ইস্যুও মেনে নেওয়া রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ১৯৬২ আর ২০২২ এক নয়। রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযানের বৈধতা পশ্চিমারাই দিয়েছেÑ যদিও রাশিয়া আমেরিকার মত দেশ দখলের উদ্দেশ্যে আগ্রাসন চালায়নি। বরং দোনেস্ক এবং লুহানেস্কের নেতাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছে মস্কো। তবে সারা বিশ্বই এখন রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান নিয়ে তোলপাড়। মূল কারণ, পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়া হচ্ছে যুদ্ধ ও দখলদারিত্ব এবং লুটতরাজের প্রধান সহযোগী। ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্ব যতটা সরব ঠিক ইরাক, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সিরিয়ার ক্ষেত্রে ততটাই নীরব! কারণ রাশিয়া ও আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম এক নয়। একটা হচ্ছে সিংহ আর অপরটি হচ্ছে হায়েনার দল! হিংস্রতা দুটোর মধ্যেই আছে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে সিংহ ভেবে গর্ববোধ করে অপরদিকে হায়েনাকে সবাই ঘৃণা করে! ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট পশ্চিমাপন্থী এবং অদরুর্র্দশী তাতে কোন সন্দেহ নাই। ঘরের মধ্যে সিংহ রেখে হায়েনার সাথে সখ্যতা করার ফল তিনি এখন হাতেনাতেই পাচ্ছেন। আমেরিকা বা ন্যাটো ইউক্রেনকে লিপ সার্ভিসের বেশি কিছু দিবে না। লুহানস্ক বা দোনেস্ককে শুধু স্বাধীনতা দেওয়াই উদ্দেশ্য নয় একই সাথে দেশটিতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও রাশিয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ ছাড়া পশ্চিমাদের হাতে দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। তার পরেও দু’দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উভয়কেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। ইউক্রেন তাঁর জনগণের স্বার্থ বুঝতে হবে। কারো প্ররোচনায় ভুল সিদ্ধান্ত নিলে নিজেদেরই ক্ষতি হবে। যুদ্ধ নয় আলোচনায় সমাধান আসতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান হোক, এটাই সকলের কাম্য। লেখক : সাংবাদিক। mushfiqurrahman2021@gmail.com
|