☰ |
|
কলাম |
এম আর খায়রুল উমাম সরকার অনেক কারণে ভর্তুকি দেয়। সেই কারণগুলো প্রকাশ্যে আনা হলে সাধারণ মানুষ প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারবে। যেমন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের চাহিদা ছিল দিনে ৯ হাজার ৬০০ ও সন্ধ্যায় ১০ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। আর এ তারিখে প্রকৃত উৎপাদন হয়েছে দিনে ৯ হাজার ৪২২ ও সন্ধ্যায় ৯ হাজার ৯৩৯ মেগাওয়াট। এ হিসাবে দেখা যায়, দেশে এখনো বিদ্যুতের লোডশেডিং চলমান দিনে ১৭৮ ও সন্ধ্যায় ৪৬১ মেগাওয়াট। ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ থেকে জনগণ ধারণা করেই নিয়েছে চলমান গ্রীষ্মকালে লোডশেডিং বাড়বে। অথচ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওয়েভ পেজ খুললেই দেখা যায়, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ২৮৪ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। সে সময়ে দেশে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৩ হাজার মেগাওয়াট তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বেসরকারি খাত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এরই মধ্যে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হয়েছে। সাধারণভাবে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় সবচেয়ে বেশি। তথ্য অনুযায়ী এখন দেশ যখন চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম তখন বেসরকারি খাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা কী, সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। তারা জানেও না সরকার কত বছরের জন্য বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি দ্রুত মোকাবেলার জন্য বেসরকারি খাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এ উদ্যোগ টেনে নিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিসংগত তা এখন বিবেচনার সময় হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে এখন নিজেদের সক্ষমতার ওপর ভরসা করা প্রয়োজন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হলেই ভর্তুকির এক বিশাল অংক থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সরকারের পরিকল্পকরা কি এ পথে হাঁটবেন? বাংলাদেশ এখনো সিস্টেম লস থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সরকারি হিসাব মতে, ৮ দশমিক ৪ শতাংশ সিস্টেম লস চলমান। পরিবহনের লস, সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের দুর্বলতার লস, যান্ত্রিক ত্রুটির লস ইত্যাদি লস হিসাব করলে চুরির লস খুব বেশি থাকবে না। সংশ্লিষ্টরা বিশ্বাস করেন চুরির লসের পুরোটাই সাধারণ সেবাগ্রাহকদের জন্য হয়। তারা নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য বিচিত্র সব পরিকল্পনাও করে। অতীতে মিটার ছিল গ্রাহকের ঘরের ভেতর, তা বের করে আনা হলো বারান্দায় এবং তারপর খোলা আকাশের নিচে বাড়ির বাইরের দেয়ালে। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার পরেও কোনোবারেই আশানুরূপ উপকার হলো না। ফলে এবার শুরু করা হলো মিটার পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা। নির্দেশ জারি করা হলো, অ্যানালগ মিটার পরিবর্তন করে ডিজিটাল মিটার ব্যবহার করতে হবে। ভালো অ্যানালগ মিটারগুলো খুলে গ্রাহকদের ডিজিটাল মিটার লাগাতে বাধ্য করা হলো। যে গ্রাহক এ নির্দেশ পালনে গড়িমসি করলেন, তাদের ব্যবহূত ইউনিটের ডবল বিল পরিশোধের শাস্তি বলবৎ করা হলো। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই নতুন কেনা ডিজিটাল মিটারের পরিবর্তে স্মার্ট প্রিপেইড মিটার আমদানি হয়ে গেল। পরিবর্তনের এ ধারায় ৪ কোটি ১৯ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৪৬ লাখ ২৭ হাজার ৬৫৮টা মিটার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। প্রকল্প চলমান রাখার জন্য কয়েক দিন আগেও একনেকে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। আবার অর্থ বরাদ্দ নিয়ে কথাও কিন্তু বলা যাবে না। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না দেশ এখন উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছে বলেই ভালো চলমান ৪ কোটি ১৯ লাখ ডিজিটাল মিটার ফেলে দেয়ার যুক্তি কী? পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল মিটার খারাপ হলে, নষ্ট হলে যদি পরিবর্তন করার নির্দেশ দেয়া হতো তাহলে এই বিপুল অর্থের ব্যবহার যথাযথ হতো বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। মূলকথা হলো, টেকসই পরিকল্পনা না হলে ভর্তুকি কমানো সহজ হবে না। তার ওপর আবার কয় টাকার মিটার কয় টাকায় কেনা হচ্ছে তাও দেখা জরুরি। সরকার দাবি করে শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলতে ভুলে গেছে এ সুবিধা দিতে গিয়ে ২০১০-১১ অর্থবছরে ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। লোকসানের কথা বলে আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনা করে মূল্যবৃদ্ধির এ প্রবণতা এখনো চলমান। সাধারণ সুবিধাভোগীদের কথা সরকার বোধকরি ভুলেই গেছে। এখন তো আবার আরো সুবিধা! প্রিপেইড মিটারের ক্ষেত্রে মানুষ শুধু জানে কত টাকা মিটারে জমা করলে সে কত টাকা পায়। সাধারণ ব্যবহারকারীরা জানেই না কখন কত টাকা মূল্যের বিদ্যুৎ তারা ব্যবহার করছে। সরকার দাবি করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সবকিছুর দাম বাড়াতে কোনো বিবেচনার প্রয়োজন হয় না। বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস-চাল-ডাল-আটা-লবণ, আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন, তরিতরকারি, সরকারকে দেয় কর এমন একটা ক্ষেত্র পাওয়া যাবে না, যা সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় তালিকায় পড়ে না। এখন তো আবার শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের গতি যেভাবে গড়াচ্ছে, তাতে বিশ্ব শুরুতেই টালমাটাল। এ যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অবধারিত। তাই পরিকল্পকরা এ সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে ভর্তুকি কমানোর উপায় হিসেবে নির্ধারণ করলে কারো কিছু বলার থাকে না। দেশের সিন্ডিকেটগুলোর পরিকল্পনা অনুযায়ী রোজার ঈদের সময়ে পণ্যের যে দাম বেড়েছে তা কমে যাবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। দেশজুড়ে মূল্যবৃদ্ধির এ উৎসবে বিদ্যুৎ কেন পিছিয়ে থাকবে? একটা সময় দেশের মানুষ ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ আর ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং ভোগ করত। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে দ্রুত মানুষের দুর্ভোগ মুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে রেন্টাল ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত করা হয়। সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০৩০ সালে দেশের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ হাজার মেগাওয়াট হবে। সাধারণ মানুষ দেখছে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে সরকার ভালোভাবেই এগিয়ে চলেছে। তবে উৎপাদন ও চাহিদার পরিকল্পনার পাশাপাশি চলার ব্যবস্থা থাকতে হয়। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জমা রাখা যায় না। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়। উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার সমন্বয় না থাকার কারণেই মূলত এ খাতের ভর্তুকি। মনে রাখা প্রয়োজন মানুষের কষ্ট লাঘবের যারা সুযোগ পেয়েছিল, তারা সবাই ক্ষমতার বলয়ের মধ্যের ব্যক্তি। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সরকারের এ ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার কথা থাকলেও ক্ষমতার বলয়ের মানুষ হিসেবে তাদের মনে কষ্ট দিতে রাজি না থাকায় সরকারের এ ভর্তুকি। এখন সরকার যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তা ব্যবহার করার পরিবেশ যেখানে তৈরি করা সম্ভব হয়নি, সেখানে বেসরকারি খাতের দামি বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহককে কম দামে সরবরাহ করার বিলাসিতা মেটাতেই এ ভর্তুকি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে যদি সংশ্লিষ্টরা তাদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন, তবে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সরকার এখন ২০৪১ সালকে সামনে রেখে রূপকল্প সাজাচ্ছে। সাধারণভাবে পরিকল্পনা আরো দীর্ঘ সময়ের হতে পারে। তবে পরিকল্পনার মধ্য থেকে যদি একটা অংশ এগিয়ে যায়, তবেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে বিগত সরকারের মতো খাম্বার উন্নয়ন হতে বাধ্য। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি ব্যবহারের জায়গা সৃষ্টি করাও জরুরি। উৎপাদিত বিদ্যুতের একটা অংশ সেফটির জন্য রেখে বাকি অংশ ব্যবহারের নিশ্চিত ক্ষেত্র তৈরি করা না হলে উৎপাদন বৃদ্ধি যৌক্তিকতা হারাবে। দেশে এখন বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ক্রমান্বয়ে যখন জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হবে তখন সমস্যা বাড়বে এবং ভর্তুকিও বাড়বে। ধীরে ধীরে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসার পরিবর্তে আরো জড়িয়ে যেতে হবে। শুধু শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার কৃতিত্বে বলীয়ান হলেই হবে না। পাশাপাশি শিল্প সম্প্রসারণে উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের বড় বড় শিল্প লোকসানের অজুহাতে বন্ধ হয়ে গেছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে এ শিল্পগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। এগুলোর জায়গায় ইপিজেড সমাধান হতে পারে না। অথচ এখন শুধু ইপিজেড আর ইপিজেড। প্রতিটি জেলায় ইপিজেড তৈরি করা হচ্ছে। লোকসানের অজুহাতে একের পর এক বস্ত্র, পাট, চিনি, ইস্পাত, নিউজপ্রিন্ট ইত্যাদির মতো বড় শিল্প বন্ধ করেছে। রফতানিনির্ভর ও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানাতে গিয়ে ভর্তুকির ফাঁদে পড়েছে। একবার ফাঁদে আটকা পড়লে তা থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। সর্বত্র আমাদের বিদেশপ্রীতি এ ফাঁদকে আরো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। যদিও আপাতত ফাঁদ কেটে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছা এখনো সরকারের দেখা যাচ্ছে না। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনের একমাত্র পথ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। সাধারণ মানুষ কিছুদিন পরপর বাণী শুনবে—উন্নত দেশ থেকে আমাদের বিদ্যুতের দাম এখনো অনেক কম, তাই কিছুটা সমন্ব্বয়ের জন্য এবার মূল্য দ্বিগুণ করা হবে। আর যে যত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে, তাকে তত বেশি দাম দিতে হবে। ভুল পরিকল্পনার ভর্তুকি সাধারণ ব্যবহারকারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে সংশ্লিষ্টরা বাহবা কুড়াবেন। এম আর খায়রুল উমাম: প্রাবন্ধিক; সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) |
কলাম |
সর্বশেষ |
xxxxxxxxxxxxxxxxx |