-মুশফিকুর রহমান পৃথিবীজুড়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিভিত্তিক যতো মাধ্যম আছে ফেসবুক তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও জাতি নির্বিশেষে মানুষ এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে। যোগাযোগের জনপ্রিয় ও আর্কষণীয় মাধ্যম এখন ফেসবুক। জনমত গঠনে ও সচেতনতা সৃষ্টিতেও ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। এইসব ইতিবাচক দিক ছাড়াও ফেসবুকের কিছু নেতিবাচক দিক আছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে বেশ আলোচিত ব্যাপার হচ্ছে ফেসবুকে গুজব ও ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি এবং তা কীভাবে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বিপর্যয়ের কারণ হচ্ছে। ফেসবুকে স্পর্শকাতর বিষয়ে অপপ্রচার চালানো, সাম্প্রদায়িকতা ঘৃণা, বিদ্বেষ ও গুজব ছড়ানো সহজ মাধ্যম হয়ে ওঠেছে। আমরা না জেনে না বুঝেই সামান্য বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করছি এবং এই ট্রলের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে অন্যেকে হেয় করা। তার বিরুদ্ধে কুৎস্যা রটনা করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল এখন আর নতুন কিছু নয়। ট্রলের মধ্য দিয়ে ঠাট্টা-মস্করা, ঘৃণা-বিদ্বেষ যে পরিমানে ছড়ানো হয়, তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাকে নিয়ে এই ট্রল করা হয়, তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অনেক সময় কুৎসিত ট্রলের আক্রমনে ডিপ্রেশনে ভোগেন। কেননা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি না থাকলেও তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা থাকেন, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। কুৎসিত ট্রলের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা করা হয় তা মূলত হয়রানি। ঘৃণা ছড়িয়ে অপদস্থ করা। বর্তমান সময়ে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছেÑ এখন সামান্য কিছু হলেই ট্রলের জন্য সেটিকে আমরা ফেসবুকে নিয়ে যাচ্ছি। কারো বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উত্থাপিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিযোগের তদন্ত কিংবা আইনগত প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার আগেই তাকে আসামি বানিয়ে দেওয়া হয়। তিনি হয়ে যান সমাজে সবচেয়ে খারাপ মানুষ! এবং সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই বিষয়ে রায় দেওয়ার জন্য। ট্রল এর রাজনৈতিক ব্যবহারকে পাশ কাটিয়ে এখন অনেক ইতিবাচক বিষয়কেও মানুষ ট্রলের শিকার হওয়ার ভয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থাপন করতে ভয় পায়। এবং এভাবে ট্রল আমাদের সমাজে ভয়ের আতঙ্ক তৈরি করছে। এখন ট্রল মানেই হলো কাউকে অপদস্থ করা, হেয় করা এবং এটি কারও বিপক্ষে ঘৃণা ছড়ানোর উদ্দেশ্য করা হয়। তবে এখানে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় এই ট্রলের শিকার হন নারী। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও এই ধরনের ট্রলের শিকার হন এবং সেখানেই উদ্দেশ্য থাকে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো। ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে ব্যক্তি বা গোষ্টির বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা মোকাবিলার ঢাকায় ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পরিমাণ ট্রল হয়েছে তা খুবেই দুঃখজনক। বিভ্রান্তিকর অসত্য সংবাদ ফেসবুক ও কিছু গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে তা রীতিমত হলুদ সাংবাদিকতা। খবরের সত্যতা যাছাই না করে কিছু অতি উৎসাহী সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে। অবাক করা বিষয়, নামী-দামি সাংবাদিকদের অনেককেই দেখি পুরুষত্বের খোলস পরে `হিট` শব্দে মজা লুফে নিতে। যা সাংবাদিকতার মূল এথিকস এর সম্পূর্ণ বিরোধী। বুশরা আফরিন পুরো এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম চিফ হিট অফিসার (সিএইচও)। আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অ্যার্ডিয়ান আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশনের রেজিলিয়েন্স সেন্টার তাকে এই পদে নিয়োগ দিয়েছে। সমাজকর্মী বুশরা আফরিন বাংলাদেশে পোশাককর্মীদের অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থেকে কাজ করেছেন। বুশরা আরেফিনকে নিয়ে যে পরিমাণ মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে মনে হয় এই মিডিয়া ট্রায়ালের বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারও একটি বিষয়ে কিংবা মতামতের বিপরীতে অন্য কারো ভিন্নমত কিংবা কারো স্বার্থবিরোধী হলেই সেখান থেকে শুরু হয় মিডিয়া ট্রায়াল এবং সামাজিকভাবে হেয় করার মানসিকতা। যথাযথ যোগ্যতা যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন বুশরার নিয়োগ প্রক্রিয়া চ’ড়ান্ত করেছে। বুশরার নিয়োগের পর বেশ কিছুদিন ধওে ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়ায় বুশরাকে তার বাবাই নিয়োগ দিয়েছেন বলে যে শোরগোল হয়েছিলো, বিভ্রান্তিকর, অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন করে মূর্খতার পরিচয় দিয়েছে কিছু সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম। ‘যারা ট্রলের শিকার তাদের মানসিক চাপ বিশ্লেষণের আগে যারা এসব ট্রল করে, তাদের মানসিক বিকার নিয়ে কথা বলা জরুরি। তারা যে ভয়ঙ্কর ও কুৎসিত মনোবিকারে ভুগছেন, সেটা এই সমাজের জন্য কতটা ভয়ের, সেটা বিবেচনায় আনলে আমরা বলতে পারি যে, ট্রলের শিকার হিসেবে তারা মূলত টার্গেট করে নারীকে। গ্রামের সাধারণ স্কুলে পড়া কিশোরীটি যেমন তাদের নোংরা ট্রলের শিকার হয়, তেমনই শিকার হন দেশের বরেণ্য ব্যক্তি ও শিল্পীরা। এই ট্রল মোকাবিলায় মানসিক শক্তি ও সামর্থ অনেকের থাকলেও গ্রামের ঐ কিশোরীটির পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ তাকে বাঁচতে হলে এসব ট্রল, অপমান আর আঘাতকে সহ্য কওে টিকে থাকতে হয়। গ্রামের বেশিরভাগ কিশোরী তার পরিবার থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পায় না। অনেক ক্ষেত্রে ঐ কিশোরীর পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটে এবং পরিবার থেকে জোর কওে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এসবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরী করতে হবে। এসব বীভৎস্য ও কুৎসিত ট্রলের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে আইন প্রণোয়ন ও প্রয়োগ দুটোই রাষ্ট্রকে করতে হবে। আমরা ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। এখানে নেই কোনও সেন্সরশিপের তোয়াক্কা, আছে অবাধ স্বাধীনতা। আমরা অন্যকে অসম্মান করতে পেরে আনন্দ পাই, কখনও জোটবেঁধে, দলবেঁধে অসম্মান করি। আমরা সবাই নিজেদের বিচারক ভাবি। সামাজিক মাধ্যমগুলো শুধুমাত্র বিরোধিতা করেই মানুষ ক্ষান্ত হচ্ছে না, করছেন গালিগালাজ, দিচ্ছে নানা কর্মসূচি। বিশেষ করে হুজুগে পড়ে নানা ধরনের গুজব, মিথ্যা সংবাদ ও রিপোর্ট শেয়ার দিচ্ছে এবং এটি থেকে অনেক সময়ই ঘটছে ধর্মীয় হাঙ্গামার মতো বড় ধরনের ঘটনা। সেটি শুধু শেয়ারেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জারি আছে ফেসবুকে ট্রায়াল। এখন একটা কিছু হলেই লোকজন সেটিকে ফেসবুকে নিয়ে যাচ্ছে, সামাজিক ট্রায়ালের জন্য। কারো বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উত্থাপিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিযোগের তদন্ত কিংবা আইনগত প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার আগেই হয়ে যান তিনি আসামি এবং সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই বিষয়ে রায় দেওয়ার জন্য। তারপর শুরু হচ্ছে সেখানেই সেই ব্যক্তির সামাজিক মৃত্যু। কারও ছবি তোলা, কথা কিংবা মিটিং রেকর্ড করার বিষয়ে অনুমতি নেওয়ার সংস্কৃতি নেই, বরং আছে উল্টোটা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই আছে। এবং এগুলো প্রকাশ করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক নিশ্চয়ই একটি সহজ ও বড় মাধ্যম। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে অত্যন্ত কদর্যভাবে। কারও মতামতের বিপরীতে অন্য কারো ভিন্নমত কিংবা কারো স্বার্থবিরোধী হলেই সেখান থেকে শুরু হয় কুৎস্যা রটানো। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ থেকে শুরু কওে রাস্তায় কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে কর্মসূচি পালন করতেও দেখা যায়। কখনও কখনও থাকে মেরে ফেলার হুমকি! ব্যক্তিগত আক্রমণের সঙ্গে অনেক সময়ই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদেরও হেয় করার প্রবণতা থাকে। কুৎসিত ট্রলের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা করা হয় তা মূলত হয়রানি। এই হয়রানি অবশ্যই অপরাধ। লেখক : সাংবাদিক
|