☰ |
|
কলাম |
শাহীন চৌধুরী ডলি সামাজিক ব্যাধি ধর্ষণের ভয়াবহতা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র ধর্ষণ নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি আদিবাসী মেয়েকে ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ৪ অক্টোবর ভাইরাল হওয়ার পর সারা দেশে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ, মতিঝিল,উত্তরা হাউজবিল্ডিং,প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে দুই সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ প্রতিবাদ চলেছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে জোরালোভাবে ধর্ষকের শাস্তি চাওয়া হলেও এতদিন ধরে অবস্থা তিমিরেই রয়ে গিয়েছিল । কিন্তু এবার প্রতিবাদের জোয়ারে সরকার নড়েচড়ে বসেছেন। আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখার পাশাপাশি আরও দুটি সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো যৌতুকের জন্য মারধরের ঘটনার ক্ষেত্রে ( ধারা ১১ এর গ)সাধারণ জখম হলে তা আপসযোগ্য হবে। এছাড়া এই আইনের চিলড্রেন এক্ট ১৯৭৪ এর ( ধারা ২০-এর ৭) পরিবর্তে শিশু আইন ২০১৩ প্রতিস্থাপিত হবে।ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অধ্যাদেশে সই করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। প্রাত্যহিকভাবে নারী নির্যাতন খুব সাধারণ ঘটনা যেন। এমন কোন একটা দিন নেই, যেদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। দেশের আনাচে কানাচে ঘটা খবরগুলো অজানাই রয়ে যায়। খুব অল্প খবর মিডিয়ার মাধমে জনগণের দৃষ্টিগোচর হয়। কন্যাশিশু থেকে নারী নিজের ঘর ,অফিস, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, উপসনালয়সহ কোথাও নিরাপদ নয়। দিন কিংবা রাত একশ্রেণির নরপশু যেন শিকার ধরার জন্য ওত পেতে থাকে। অনেক ধর্ষক শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না,উপরন্তু কুকর্মের পর ভিকটিমকে খুন করছে।কেউ কেউ কুকর্মের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে ধর্ষিতাকে সামাজিকভাবে হেয় করার দুরভিসন্ধিমূলক কাজে লিপ্ত। সবচেয়ে বড় বর্বরতা ধর্ষণ, যার শিকার হচ্ছে ৬ মাসের দুধের শিশুকন্যা থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত। রাষ্ট্রে ধর্ষকের শাস্তির কঠোর বিধান থাকা সত্বেও বর্বরোচিত ঘটনা কেন থামছে না? একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে পড়ে আছি।বিশ্বের সাথে সাথে দেশ যতই সভ্যতার পথে এগিয়ে যাক না কেন বিকৃত যৌন ক্ষুধার এক শ্রেণির নরপশুর হাত থেকে নারীর মুক্তি মিলছে না। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নির্মম হত্যা লাগাতারভাবে বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের শিকার একজন নারী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাবোধ হারিয়ে ফেলে। কোন দোষ না থাকা সত্বেও পরিবারে, সমাজে নিগৃহীত হয় ভিকটিক।ধর্ষণের শিকার একজন নারীর পাশাপাশি তার পরিবারেও ক্ষতের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকতা হারিয়ে সারাজীবন তারা দূর্বিষহ জীবন বয়ে চলেন। ধর্ষক কি করে ভুলে যায়, যে মায়ের গর্ভে সে জন্ম নিয়েছে, যার স্তন্যপান করেছে, যে তাকে লালনপালন করে বড় করে তুলেছে সেই জননীও একজন নারী!যৌন নিপীড়নকারী একজন দানবের কোন পরিচয় হয় না। যৌন নিপীড়ক বাবা ,চাচা, ভাই, মামা, খালু, ফুফা,শিক্ষক,হুজুর,পাদ্রী,পুরুত,বস, সহকর্মী নন বরং ধর্ষকের একটাই পরিচয় সে নারীখেকো পিশাচ। গত কয়েকবছর ধরে উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণ বৃদ্ধির ঘটনা বাংলাদেশের মানুষকে আতংকিত ও অসহায় করে তুলেছে।বিক্ষুব্ধ মানুষ পথে নেমে বিক্ষোভ জানাচ্ছে। প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ক্ষোভ জানিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন, ধর্ষককে আটক করে জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলানো হোক। কেউ কেউ চাইছেন ধর্ষককে ক্রসফায়ারে মারা হোক। আমরা নারীরা নিজেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের শিশু ও মেয়েদের নিয়েও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সন্তানকে মানুষরূপী জানোয়ারের নজর থেকে বাঁচিয়ে কিভাবে আগলে রাখবো এই দুশ্চিন্তা সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ৮১৮ জন ধর্ষিত হয়েছে। ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণের পর ৬৩ জনকে হত্যা করা হয়।২০১৯ সালে ১৪১৩ জন ধর্ষিত হয় এবং ধর্ষণের শিকার হয়ে খুন হয় ৭৬ জন। ২০২০ সালের গত নয় মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন ধর্ষণের পর ৪৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে।যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ জন নারী। আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে ৩ জন নারী এবং ৯ জন পুরুষকে নিহত হতে হয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন নারী সংগঠন, নারীবাদীরা এবং সরকার সোচ্চার হওয়া সত্বেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। গলদটা খুঁজে বের করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে অনৈতিক ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিচারব্যবস্থা আধুনিক করে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ধর্ষককে পারিবারিক বা রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাড় দেয়া যাবে না। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি অসম্মানজনক যেকোন ধরনের মামলা নেওয়ার ব্যাপারে পুলিশকে তড়িৎকর্মা হতে হবে।ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। শতকরা ৯৭ ভাগ ধর্ষণ মামলায় বাস্তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দ্রুততার সাথে আইনের কঠিন প্রয়োগ থাকলে কোন একজন পুরুষ ধর্ষণ করার দুঃসাহস পেতো না। রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে বলেই অপরাধীরা আইনকে তোয়াক্কা করে না। বিবেকবান বহু পুরুষ আজ ধর্ষকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তারা বুঝতে পারছেন, আজ অন্যের মা, স্ত্রী, বোন, সন্তান ধর্ষকের লোলুপতার শিকার হচ্ছে। কাল তার নিজ পরিবারের কোন নারী ধর্ষণের শিকার হবে না এর নিশ্চয়তা নেই। শুধুমাত্র আইনের সংস্কার ও শাস্তি প্রদান করে ধর্ষণের জঘন্য অপরাধ থামানো যাচ্ছে না। মৃত্যুদণ্ডের আইন অধ্যাদেশ জারির পরেও দেশের কোথাও না কোথাও এখনো ধর্ষণ চলছেই। আসলে গলদটা কোথায়? ধর্ষণের প্রকোপ কমাতে প্রয়োজন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধতা। আইন শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সততা। আইনকে নিজের মত চলতে দিতে হবে।আইনি প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি সম্মানের মানসিকতা গড়ে তুলতে শিক্ষা দিতে হবে। নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেকোন সামাজিক অপরাধে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। লেখাকাল, ২০ অক্টোবর ২০২০ |
কলাম |
সর্বশেষ |
xxxxxxxxxxxxxxxxx |